নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান

নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান হিসাবে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, গান্ধী আশ্রম নোয়াখালী, নিঝুম দ্বীপ ও বজরা শাহী মসজিদ উল্লেখযোগ্য।

নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান নিঝুম দ্বীপ
নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া এবং মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ

নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া এবং মনপুরা দ্বীপ ভ্রমণ

একদিকে মেঘনা নদী আর তিনদিকে বঙ্গোপসাগর ঘিরে রেখেছে অগণিত শ্বাসমূলে ভরা কেওড়া বাগানের এক সবুজ দ্বীপকে। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটার এই দ্বীপের এক পাশ ঢেকে আছে সাদা বালুতে, আর অন্য পাশে সৈকত। এখানে শীতকালে বসে হাজার পাখির মেলা। বন্য কুকুর আর সাপের অভয়ারণ্য এই বনের সবুজ ঘাস চিরে সারা দিন দৌড়ে বেড়ায় চিত্রা হরিণের দল। এই হলো নিঝুম দ্বীপ

নিঝুম দ্বীপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো মাইলের পর মাইল জুড়ে কেওড়া বন আর সেই বনের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিত্রা হরিণ। এই বন দেখার জন্যই নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ করা। হাতিয়ার মেঘভাষান ঘাট থেকে মাত্র ১৫ টাকায় নৌকা নিয়ে পার হয়ে আসা যায় এই দ্বীপে, এখানে নেমে প্রথমেই যে বিষয়টা নজর কাড়ে, সেটা হলো খোলা মাঠ, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের শেষ যে কোথায় হয়েছে, সেটা দেখার সাধ্য কারো নেই। নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা বাজার ঘাটে নেমেই নজরে পড়ে একটা পাকা সড়ক, সোজা চলে গেছে দ্বীপের বুক চিরে!

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নোয়াখালী
নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী

নোয়াখালী শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সোনাইমুড়ী উপজেলা। সেখান থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে বাগপাঁচড়া গ্রামকে লোকজন আমিননগর নামেই চেনে। ২০ জুলাই ২০০৮ সালে এখানে রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের জুন মাসে নোয়াখালী জেলার সাবেক বেগমগঞ্জ থানার বর্তমানে সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাদুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজাহার পাটোয়ারী, মা জুলেখা খাতুন। নৌবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মোহাম্মদ রুহুল আমিন গোপনে পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটি ত্যাগ করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে বহু স্থলযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টর থেকে নৌবাহিনীর সদস্যদের সেপ্টেম্বর মাসে একত্রিত করা হয়। ভারত সরকারের উপহার দুইটি টাগ-বোটে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে শুরু হয় নৌযুদ্ধের প্রস্তুতি। গার্ডেন রীচ নৌ ওয়ার্কশপে টাগ-বোট দুটিতে দুটি করে বাফার গান আর চারটি করে ৫০০ পাউন্ড ওজনের মার্ক মাইন বহন করার উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তরিত করা। ১২ অক্টোবর গার্ডেন রীচ জেটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গানবোট দুটিকে পানিতে ভাসান হয়। ‘পলাশ’-এর ইঞ্জিন রুমের প্রধান আর্টিফিসারের দায়িত্ব পান তিনি। ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌঘাঁটি ও পিএনএস তিতুমীর দখল করার সময় পাক-বিমানবাহিনীর আক্রমণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেন। সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ দুঃসাহসী বীর নাবিক মোহাম্মদ রুহুল আমিন অনায়াসেই জাহাজ ত্যাগ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। কারণ সেই মুহূর্তে তার নিজের প্রাণের চেয়েও মূল্যবান ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর রণতরী। ‘পলাশ’কে রক্ষা করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে পবিত্রতম দায়িত্ব। জীবনের মায়াকে তুচ্ছ মনে করে অবিচল ছিলেন দেশপ্রেম আর কতর্ব্যজ্ঞানের কাছে। ‘পলাশ’ ভাগ্যের সঙ্গে নিজ ভাগ্যকে মিলিয়ে দিয়ে হলেন পলাশ রঙে রক্তিম। মহান এ বীরকে সমাহিত করা হয় খুলনার রূপসা ফেরিঘাটের পূর্বপাড়ে।

গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান
নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান গান্ধী আশ্রম

গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর অন্যতম প্রধান পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান

বাংলাদেশজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য প্রাকৃতিক আর মনুষ্যনির্মিত দর্শনীয় স্থান। মূলত এই স্থানগুলোর কথা মাথায় রেখেই আজকের আয়োজনে থাকছে একটি দর্শনীয় স্থানের বিবরণ। আর আজ এতে প্রকাশিত হলো নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম-এর কথা।

গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর একটি দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন। নোয়াখালী জেলা সদর মাইজদী কোর্ট হতে প্রায় ২৫ কিমি উত্তরে সোনামুড়ী উপজেলার জয়াগ বাজার সংলগ্ন সড়কের পাশে এর অবস্থান। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে নোয়াখালিতে যে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাতের সূত্রপাত হয় সেই সংঘাত তথা দাঙ্গার খবর শুনে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং ৭ নভেম্বর, ১৯৪৬-এ তিনি নোয়াখালীর চৌমুহনী রেল স্টেশনে এসে পৌঁছান। এরপর দত্তপাড়া এলাকায় সভার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গান্ধীর গ্রাম পরিক্রমা এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি জয়াগ গ্রামে যান। আর ৩০ জানুয়ারি তিনি সেখানে উদ্ধোধন করেন একটি বুনিয়াদী বিদ্যালয় যা বর্তমানে 'গান্ধী মেমোরিয়াল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট' নামে পরিচিত। সে সময় নোয়াখালীর জমিদার ছিলেন ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ। তিনি গান্ধীর জয়াগ আগমন এবং তার বাড়িতে গান্ধীজির অবস্থানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে নিজের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মহাত্মা গান্ধীকে দান করেন এবং তার পিতামাতার নামানুসারে 'অম্বিকা কালীগঙ্গা চেরিটেবল ট্রাস্ট' নামের একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। তবে ১৯৭৫ সালে এক সরকারি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে 'অম্বিকা কালীগঙ্গা চেরিটেবল ট্রাস্ট' ভেঙে 'গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট' সৃষ্টি করা হয়। চারু চৌধুরী ছিলেন এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি। ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ আরেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পাওয়ায় গান্ধীজি বিহার ফিরে যাওয়ার আগে চারু চৌধুরীকে নোয়াখালীতে শান্তি মিশন ও ট্রাস্টের কাজ চালিয়ে যেতে বলেন এবং আবার নোয়াখালী আসার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে পরের বছরই তিনি মৃত্যুবরণ করায় তার আর নোয়াখালী বা জয়াগে আসার সুযোগ হয়নি। এদিকে গান্ধীজি না আসতে পারলেও চারু চৌধুরী গান্ধীজিকে দেওয়া কথা অনুযায়ী ট্রাস্ট আর শান্তি মিশনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। বর্তমানে গান্ধী আশ্রমে গান্ধীজির নামে একটি জাদুঘরও আছে যাতে গান্ধীজির তখনকার নোয়াখালী সফরের একশতাধিক ছবি ও ব্যবহূত জিনিসপত্র ও প্রকাশিতলেখা সংরক্ষিত আছে।

বজরা শাহী মসজিদ নোয়াখালী জেলার পর্যটন অঞ্চল ও দর্শনীয় স্থান
বজরা শাহী মসজিদ

বজরা শাহী মসজিদ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী

বজরা শাহী মসজিদ নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা নামক গ্রামের একটি বড় পুকুরের উত্তরপাড়ে অবস্থিত। এ পুকুরে একটি বাঁধানো ঘাট আছে। প্রধান প্রবেশপথের উপর স্থাপিত একটি শিলালিপির বর্ণনা অনুযায়ী মুগল সম্রাট মুহম্মদ শাহের আমলে জনৈক আমানউল্লাহ কর্তৃক ১৭৪১-৪২ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়।

বেষ্টনী দেওয়ালের প্রবেশপথের উপরাংশে এবং মসজিদের ভেতরের দেওয়ালে লাগানো বাংলা ও ফারসি ভাষায় লিখিত শিলালিপির তথ্যানুযায়ী বাংলা ১৩১৮ (১৯১১ ইং) থেকে ১৩৩৫ (১৯২৮ ইং) সনের মধ্যে বজরার জমিদার খান বাহাদুর আলী আহমদ এবং খান বাহাদুর মুজির উদ্দীন আহমদ কর্তৃক এ মসজিদ সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ দেয়ালে সংস্থাপিত একটি বাংলা শিলালিপিতে উল্লেখ আছে যে, ঢাকার বেনজীর উস্তাগর মসজিদের সংস্কার কাজ সম্পাদন করেন। চীনামাটির পাত্রের টুকরার সাহায্যে করা অলংকরণও ওই সময়েই করা। মসজিদটি বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।